
পৃথিবীর বাইরে জীবন: বিজ্ঞানীরা কি এলিয়েন বা বহির্জাগতিক প্রাণীর খোঁজ পেয়েছেন?
সূচিপত্র (Table of Contents - TOC)
- বহির্জাগতিক প্রাণ: বর্তমান বৈজ্ঞানিক অবস্থান
- জীবনের সন্ধানে কোথায় নজর রাখছে বিজ্ঞান
- মঙ্গলের রহস্য: অতীতে কি জীবন ছিল?
- বহিঃসৌরজগৎ (Exoplanet) ও জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের ভূমিকা
- ELIEN-দের সংকেত: SETI ও 'ওয়াও!' সিগন্যাল
- চূড়ান্ত প্রমাণ: কেন বিজ্ঞানীরা এত সতর্ক?
১. বহির্জাগতিক প্রাণ: বর্তমান বৈজ্ঞানিক অবস্থান
প্রশ্নটি সহজ হলেও উত্তরটি এখনো সহজ নয়। বৈজ্ঞানিকভাবে নিশ্চিতভাবে এখনও পৃথিবীর বাইরে কোনো এলিয়েন (Alien) বা বহির্জাগতিক প্রাণীর অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়নি। তবে এর অর্থ এই নয় যে তারা নেই। বরং, বিজ্ঞানের প্রমাণের ক্ষেত্রে একটি উচ্চ মানদণ্ড (High Standard of Proof) রয়েছে।
অধিকাংশ বিজ্ঞানী দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে এই বিশাল মহাবিশ্বে পৃথিবীর বাইরে অন্তত সরলতম অণুজীবের অস্তিত্ব থাকা খুবই সম্ভব। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতেই ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন গ্রহ থাকতে পারে, যার মধ্যে কোটি কোটি গ্রহ বাসযোগ্য অঞ্চলের (Habitable Zone) মধ্যে অবস্থিত। কার্ল সেগানের বিখ্যাত উক্তি, "The universe is a pretty big place. If it's just us, seems like an awful waste of space"—এর উপর ভিত্তি করেই এই অনুসন্ধান চলছে।
২. জীবনের সন্ধানে কোথায় নজর রাখছে বিজ্ঞান
পৃথিবীর বাইরের জীবনে অনুসন্ধানের মূল ভিত্তি হলো জল (Water) এবং জৈব অণু (Organic Molecules)। মহাকাশে যে স্থানগুলোতে এই উপাদানগুলো পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, বিজ্ঞানীরা সেখানেই খুঁজছেন:
- মঙ্গল গ্রহ (Mars): অতীতে এখানে জল ও উষ্ণ পরিবেশ ছিল বলে প্রমাণ মিলেছে।
- শনি ও বৃহস্পতির বরফের চাঁদ: বৃহস্পতির চাঁদ ইউরোপা (Europa) এবং শনির চাঁদ এনসেলাডুস (Enceladus)-এর বরফের নিচে বিশাল নোনা জলের সমুদ্র থাকার সম্ভাবনা রয়েছে, যেখানে জীবনের উৎপত্তি হতে পারে।
- বহিঃসৌর জাগতিক গ্রহ (Exoplanets): অন্য নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণকারী গ্রহগুলোর মধ্যে যারা তাদের নক্ষত্রের বাসযোগ্য অঞ্চলে রয়েছে।
৩. মঙ্গলের রহস্য: অতীতে কি জীবন ছিল?
নাসা-র পারসিভারেন্স (Perseverance) রোভার বর্তমানে মঙ্গলের জেজেরো ক্রেটার (Jezero Crater)-এ কাজ করছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই ক্রেটারটি একসময় বিশাল হ্রদ ছিল। রোভারটি সেখান থেকে এমন কিছু পাথরের নমুনা সংগ্রহ করেছে, যাতে 'বায়োসিগনেচার' (Biosignature) বা প্রাচীন অণুজীবের সম্ভাব্য চিহ্ন পাওয়া যেতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, বিজ্ঞানীরা "স্যাফায়ার ক্যানিয়ন" (Sapphire Canyon) নামের একটি নমুনায় এমন কিছু জৈব কার্বন (Organic Carbon) এবং খনিজ পদার্থের সন্ধান পেয়েছেন, যা পৃথিবীতে জীবনের মাধ্যমে তৈরি হয়। তবে এই প্রমাণগুলো চূড়ান্ত নয়। এই নমুনাগুলো পৃথিবীতে ফিরিয়ে এনে বিস্তারিত পরীক্ষার পরই নিশ্চিত হওয়া যাবে যে মঙ্গলে সত্যি জীবন ছিল কি না।
৪. বহিঃসৌরজগৎ (Exoplanet) ও জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের ভূমিকা
বহিঃসৌরজগতে জীবনের খোঁজে সবচেয়ে বড় আশা দেখাচ্ছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (JWST)।
- K2-18 b গ্রহ: পৃথিবী থেকে ১২৪ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এই সুপার-আর্থ (Super-Earth) গ্রহটি তার নক্ষত্রের বাসযোগ্য অঞ্চলে রয়েছে। JWST এর বায়ুমণ্ডল বিশ্লেষণ করে মিথেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং জলীয় বাষ্পের সন্ধান পেয়েছে।
- ডাইমিথাইল সালফাইড (DMS) অণু: আরও সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণে বিজ্ঞানীরা ডাইমিথাইল সালফাইড (DMS) নামক একটি অণুর সম্ভাব্য ইঙ্গিত পেয়েছেন। পৃথিবীতে এই অণুটি প্রধানত সামুদ্রিক ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন (Marine Phytoplankton) দ্বারা তৈরি হয়। যদি এই DMS-এর উপস্থিতি নিশ্চিত হয়, তবে এটি হবে আমাদের সৌরজগতের বাইরে জীবনের সবচেয়ে শক্তিশালী ইঙ্গিত। তবে এর জন্যও আরও গবেষণা এবং প্রমাণ প্রয়োজন।
৫. ELIEN-দের সংকেত: SETI ও 'ওয়াও!' সিগন্যাল
বুদ্ধিমান বহির্জাগতিক প্রাণীর (Intelligent Life) খোঁজে বিজ্ঞানীরা SETI (Search for Extraterrestrial Intelligence) প্রোগ্রাম চালান।
- 'ওয়াও!' সিগন্যাল (The 'Wow!' Signal): ১৯৭৭ সালে একটি রেডিও টেলিস্কোপ থেকে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ও অস্বাভাবিক রেডিও সংকেত ধরা পড়ে, যা ৭২ সেকেন্ড স্থায়ী ছিল। এটি সেই সময় একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানীকে এতটাই বিস্মিত করে যে তিনি প্রিন্টআউটে "Wow!" শব্দটি লিখেছিলেন। সংকেতটি ভিনগ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণীর হতে পারে বলে মনে করা হলেও, এর উৎস আর কখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফলে এটিও চূড়ান্ত প্রমাণ হিসেবে গণ্য হয়নি।
- পৃথিবীর সংকেত: সাম্প্রতিক নাসা-র একটি গবেষণা থেকে জানা গেছে যে আমরা মঙ্গল রোভারের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য যে রেডিও সিগনাল পাঠাই, তার একটি অংশ মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে এবং তত্ত্বীয়ভাবে এলিয়েন সভ্যতা দ্বারা সেটি শনাক্ত হতে পারে।
৬. চূড়ান্ত প্রমাণ: কেন বিজ্ঞানীরা এত সতর্ক?
চূড়ান্ত উত্তর হলো: না। এখন পর্যন্ত এলিয়েন বা বুদ্ধিমান বহির্জাগতিক প্রাণের অস্তিত্বের কোনো নিশ্ছিদ্র, সন্দেহাতীত বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
বিজ্ঞানে একটি দাবি তখনই গৃহীত হয় যখন তা বারবার পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ দ্বারা নিশ্চিত করা যায়। বহির্জাগতিক জীবনের মতো একটি অসাধারণ দাবির (Extraordinary Claim) জন্য অসাধারণ প্রমাণের (Extraordinary Evidence) প্রয়োজন। বর্তমানে পাওয়া সমস্ত প্রমাণ (যেমন মঙ্গলের জৈব অণু বা K2-18 b-তে DMS) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হলেও, বিজ্ঞানীরা কোনো প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকেও বাদ দিতে পারেন না যা জীবনের অনুপস্থিতিতেও একই ধরনের রাসায়নিক বা সংকেত তৈরি করতে পারে।
সচরাচর জিজ্ঞাস্য প্রশ্নাবলী (FAQ)
প্রশ্ন ১: ইউএফও (UFO) বা ইউএপি (UAP) কি এলিয়েনকে প্রমাণ করে?
উত্তর: না। ইউএফও (UFO - Unidentified Flying Object) বা এর নতুন নাম ইউএপি (UAP - Unidentified Aerial Phenomena) হলো এমন বস্তু বা ঘটনা যার উৎস আমরা তাৎক্ষণিকভাবে চিহ্নিত করতে পারিনি। এদের বেশিরভাগই পৃথিবীর কোনো বিমান, আবহাওয়ার বেলুন, বা ক্যামেরার ত্রুটি হতে পারে। এগুলোর কোনোটিই এখন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিকভাবে এলিয়েন বা তাদের যান হিসেবে নিশ্চিত হয়নি।
প্রশ্ন ২: পৃথিবীর বাইরে জীবন পেলে তা কি দেখতে মানুষের মতো হবে?
উত্তর: সম্ভবত না। পৃথিবীর জীবন ডিএনএ (DNA) এবং জলের উপর ভিত্তি করে গঠিত। অন্য গ্রহে ভিন্ন পরিবেশ ও রাসায়নিক উপাদানের কারণে সেখানে জীবন যদি বিকশিত হয়, তবে তা দেখতে সম্পূর্ণ ভিন্ন হতে পারে। তা অণুজীব, অদ্ভুত উদ্ভিদ, বা সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনো কাঠামোর হতে পারে।
প্রশ্ন ৩: K2-18 b-তে যদি DMS নিশ্চিত হয়, তবে কি তা এলিয়েন?
উত্তর: যদি DMS-এর উপস্থিতি নিশ্চিত হয়, তবে তা হবে একটি শক্তিশালী জৈব-স্বাক্ষর (Strong Biosignature)। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে এটি এলিয়েন। বিজ্ঞানীরা প্রথমে নিশ্চিত করার চেষ্টা করবেন যে এমন কোনো প্রাকৃতিক ভূ-রাসায়নিক প্রক্রিয়া আছে কি না যা DMS তৈরি করতে পারে। যদি এমন কোনো প্রক্রিয়া না থাকে, তবেই এটি জীবনের উপস্থিতি হিসেবে বিবেচিত হবে।