Post Image

নিউক্লিয়ার ফিউশন : পৃথিবীর বুকে সূর্য তৈরি করে অফুরন্ত শক্তি অর্জনের দৌড়ে আমরা কোথায়?


সূচিপত্র (Table of Contents - TOC)


  1. ভূমিকা: নিউক্লিয়ার ফিউশন কী এবং কেন এটি ভবিষ্যতের শক্তি?
  2. যেভাবে কাজ করে ফিউশন: সূর্যের শক্তির রহস্য
  3. নিউক্লিয়ার ফিউশনের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো
  4. ১. চরম তাপমাত্রা ও চাপ তৈরি
  5. ২. প্লাজমা নিয়ন্ত্রণ (Plasma Confinement)
  6. ৩. শক্তির লাভ (Net Energy Gain)
  7. সাম্প্রতিক অগ্রগতি ও মাইলফলক: আমরা কতদূর এসেছি?
  8. ITER (আন্তর্জাতিক থার্মোনিউক্লিয়ার এক্সপেরিমেন্টাল রিঅ্যাক্টর): আন্তর্জাতিক সহযোগিতা
  9. NIF (ন্যাশনাল ইগনিশন ফ্যাসিলিটি): নেট শক্তি লাভে যুগান্তকারী সাফল্য
  10. JET (জয়েন্ট ইউরোপিয়ান টোরাস): শক্তি উৎপাদনে নতুন রেকর্ড
  11. ফিউশন শক্তি কি নিরাপদ?
  12. সাধারণ জিজ্ঞাস্য (FAQ)
  13. উপসংহার: কবে আসবে ফিউশন শক্তির যুগ?



ভূমিকা: নিউক্লিয়ার ফিউশন কী এবং কেন এটি ভবিষ্যতের শক্তি?


নিউক্লিয়ার ফিউশন (Nuclear Fusion) হলো সেই পারমাণবিক বিক্রিয়া যা সূর্য এবং অন্যান্য নক্ষত্রকে শক্তি জোগায়। এই প্রক্রিয়ায়, দুটি হালকা পরমাণুর নিউক্লিয়াস একত্রিত হয়ে একটি ভারী নিউক্লিয়াস গঠন করে এবং বিপুল পরিমাণ শক্তি নির্গত করে। বিজ্ঞানীরা কয়েক দশক ধরে পৃথিবীতে এই প্রক্রিয়াটির অনুকরণ করার চেষ্টা করছেন, কারণ এটি মানবজাতির জন্য একটি পরিষ্কার, নিরাপদ এবং প্রায় অফুরন্ত শক্তির উৎস হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রাখে। জীবাশ্ম জ্বালানির দূষণ এবং পারমাণবিক ফিশনের ঝুঁকি—এই দুই সমস্যারই সমাধান হতে পারে নিউক্লিয়ার ফিউশন।


যেভাবে কাজ করে ফিউশন: সূর্যের শক্তির রহস্য


সূর্যের কেন্দ্রে প্রচণ্ড চাপ এবং প্রায় ১.৫ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় হাইড্রোজেনের পরমাণুগুলো একত্রিত হয়ে হিলিয়াম পরমাণুতে পরিণত হয়। এই প্রক্রিয়ায় আইনস্টাইনের বিখ্যাত সূত্র E=mc2 অনুযায়ী, হারিয়ে যাওয়া সামান্য ভর বিশাল শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।

পৃথিবীতে এই বিক্রিয়া ঘটানোর জন্য বিজ্ঞানীরা হাইড্রোজেনের দুটি আইসোটোপ—ডিউটেরিয়াম (Deuterium) এবং ট্রিটিয়াম (Tritium)—ব্যবহার করেন। ডিউটেরিয়াম সমুদ্রের পানিতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় এবং ট্রিটিয়াম লিথিয়াম থেকে তৈরি করা সম্ভব, যা পৃথিবীতে সহজলভ্য।


নিউক্লিয়ার ফিউশনের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো


পৃথিবীর বুকে একটি "ছোট সূর্য" তৈরি করা প্রযুক্তিগতভাবে অত্যন্ত জটিল। প্রধান তিনটি চ্যালেঞ্জ হলো:

১. চরম তাপমাত্রা ও চাপ তৈরি: ফিউশন বিক্রিয়া শুরু করার জন্য সূর্যের কেন্দ্রের চেয়েও বেশি, অর্থাৎ প্রায় ১০ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার প্রয়োজন। এই চরম তাপমাত্রায় পদার্থ তার চতুর্থ অবস্থা—প্লাজমা (Plasma)—তে রূপান্তরিত হয়।

২. প্লাজমা নিয়ন্ত্রণ (Plasma Confinement): এই অতি-উত্তপ্ত প্লাজমাকে কোনো পার্থিব পাত্রে রাখা সম্ভব নয়, কারণ এটি যেকোনো কিছুকে গলিয়ে দেবে। তাই বিজ্ঞানীরা দুটি প্রধান পদ্ধতিতে প্লাজমাকে নিয়ন্ত্রণ করেন:

  1. চৌম্বকীয় নিয়ন্ত্রণ (Magnetic Confinement): টোকামাক (Tokamak) নামক ডোনাট-আকৃতির যন্ত্রে শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র ব্যবহার করে উত্তপ্ত প্লাজমাকে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়।
  2. জড়তাভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ (Inertial Confinement): একটি ক্ষুদ্র জ্বালানির বড়িকে শক্তিশালী লেজার রশ্মি দিয়ে দ্রুত উত্তপ্ত ও সংকুচিত করে ফিউশন ঘটানো হয়।

৩. শক্তির লাভ (Net Energy Gain): একটি ফিউশন চুল্লিকে কার্যকর হতে হলে, বিক্রিয়াটি চালু রাখতে যে পরিমাণ শক্তি খরচ হয়, তার চেয়ে বেশি শক্তি উৎপাদন করতে হবে। একে "নেট এনার্জি গেইন" বা "ইগনিশন (Ignition)" বলা হয়। এটিই ফিউশন গবেষণার সবচেয়ে বড় লক্ষ্য।


সাম্প্রতিক অগ্রগতি ও মাইলফলক: আমরা কতদূর এসেছি?


কয়েক দশকের গবেষণার পর, বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি কিছু যুগান্তকারী সাফল্য অর্জন করেছেন যা ফিউশন শক্তিকে আগের চেয়ে অনেক বেশি বাস্তবসম্মত করে তুলেছে।

  1. ITER (আন্তর্জাতিক থার্মোনিউক্লিয়ার এক্সপেরিমেন্টাল রিঅ্যাক্টর): ফ্রান্সের দক্ষিণে ৩৫টি দেশের সহযোগিতায় বিশ্বের বৃহত্তম টোকামাক তৈরি হচ্ছে। এর লক্ষ্য হলো ফিউশন শক্তির বাণিজ্যিক ব্যবহারযোগ্যতা প্রমাণ করা। এটি যে শক্তি খরচ করবে, তার চেয়ে ১০ গুণ বেশি শক্তি উৎপাদন করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
  2. NIF (ন্যাশনাল ইগনিশন ফ্যাসিলিটি): ২০২২ সালের ডিসেম্বরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই গবেষণা কেন্দ্রটি ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নেট এনার্জি গেইন অর্জনের ঘোষণা দেয়। তারা লেজার ব্যবহার করে ফিউশন বিক্রিয়া থেকে যতটা শক্তি খরচ করেছিল, তার চেয়ে প্রায় ১.৫ গুণ বেশি শক্তি উৎপাদন করতে সক্ষম হয়। এটি একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক।
  3. JET (জয়েন্ট ইউরোপিয়ান টোরাস): ২০২৩ সালে, যুক্তরাজ্যের এই ফিউশন গবেষণা চুল্লিটি সবচেয়ে বেশি সময় ধরে শক্তি উৎপাদনের বিশ্বরেকর্ড স্থাপন করে। এটি ৫ সেকেন্ডে ৫৯ মেগাজুল শক্তি উৎপাদন করে, যা ফিউশন প্রযুক্তির স্থায়িত্ব প্রমাণ করে।


ফিউশন শক্তি কি নিরাপদ?


হ্যাঁ, নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রচলিত পারমাণবিক ফিশন (যা ইউরেনিয়াম ভাঙে) চুল্লির চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ।

  1. কোনো চেইন রিঅ্যাকশন নেই: ফিউশন বিক্রিয়া নিজে থেকে চলতে পারে না; জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করলে বা কোনো ত্রুটি দেখা দিলে বিক্রিয়া তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়, তাই মেল্টডাউনের কোনো ঝুঁকি নেই।
  2. ন্যূনতম তেজস্ক্রিয় বর্জ্য: এটি কোনো দীর্ঘস্থায়ী পারমাণবিক বর্জ্য তৈরি করে না।


সাধারণ জিজ্ঞাস্য (FAQ)


প্রশ্ন ১: নিউক্লিয়ার ফিউশন ও ফিশনের মধ্যে মূল পার্থক্য কী?

উত্তর: ফিউশন প্রক্রিয়ায় দুটি হালকা পরমাণু (যেমন হাইড্রোজেন) একত্রিত হয়ে শক্তি তৈরি করে, যা সূর্য করে থাকে। অন্যদিকে, ফিশন প্রক্রিয়ায় একটি ভারী পরমাণুকে (যেমন ইউরেনিয়াম) ভেঙে শক্তি উৎপাদন করা হয়, যা প্রচলিত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত হয়।

প্রশ্ন ২: ফিউশন পাওয়ার প্ল্যান্ট কবে নাগাদ বাস্তবে চালু হতে পারে?

উত্তর: সাম্প্রতিক সাফল্য সত্ত্বেও, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ফিউশন পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরি করতে এখনও কয়েক দশক সময় লাগতে পারে। বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞের মতে, ২০৫০ সালের পর প্রথম বাণিজ্যিক প্ল্যান্ট চালু হতে পারে।

প্রশ্ন ৩: ফিউশনের জ্বালানি কী এবং তা কি সহজলভ্য?

উত্তর: এর প্রধান জ্বালানি ডিউটেরিয়াম ও ট্রিটিয়াম। ডিউটেরিয়াম সমুদ্রের পানিতে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে এবং ট্রিটিয়াম পৃথিবীতে সহজলভ্য লিথিয়াম থেকে চুল্লির ভেতরেই তৈরি করা সম্ভব। তাই এর জ্বালানি প্রায় অফুরন্ত।


উপসংহার: কবে আসবে ফিউশন শক্তির যুগ?


নিউক্লিয়ার ফিউশন এখন আর কেবল কল্পবিজ্ঞান নয়। NIF-এর নেট এনার্জি গেইন অর্জন এবং ITER-এর মতো বিশাল প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা প্রমাণ করেছি যে পৃথিবীর বুকে একটি কৃত্রিম সূর্য তৈরি করা সম্ভব। যদিও বাণিজ্যিক ব্যবহার এখনও কয়েক দশক দূরে, তবে এই প্রযুক্তি মানবজাতির শক্তির চাহিদা মেটাতে এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় একটি বৈপ্লবিক সমাধান হতে পারে। আমরা ফিউশন শক্তির একটি নতুন যুগের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি।

EiAmi.com