দীওয়ান-ই-হাফিজ (অনুবাদ)

নজরুল-অনূদিত ‘দীওয়ান-ই-হাফিজ'-এর অগ্রন্থিত একাংশ -আবদুল মান্নান সৈয়দ
কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) সর্বাধিক উদ্বুদ্ধ অনুপ্রেরিত-আলোড়িত হয়েছিলেন ফারসি কবিদের দ্বারা। তিনজন ফরাসি কবির কবিতা নজরুল অনুবাদ করেন : ওমর খৈয়াম (-১১২৩), জালালউদ্দীন রুমি (১২০৭-৭৩) এবং শামসুদ্দীন মুহম্মদ হাফিজের (১৩২৫-৮৯)। এঁদের মধ্যেও আবার নজরুল সর্বাধিক উজ্জীবিত ছিলেন হাফিজ-এর কবিতায়। নজরুলের বন্ধু কমরেড মুজফফর আহমদ (১৮৮৯-১৯৭৩) নজরুলের করাচি থেকে কলকাতায় ফেরার পরে বর্ণনায় লিখছেন : ‘কৌতূহলের বশে আমরা তার গাঁটরি বোঁচকাগুলি খুলে দেখলাম।... কবিতার খাতা, গল্পের খাতা, পুঁথি-পুস্তক, মাসিক পত্রিকা এবং রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি, ইত্যাদিও ছিল। পুস্তকগুলির মধ্যে ছিল ইরানের মহাকবি হাফিজের দিওয়ানের একখানা খুব বড় সংস্করণ। তাতে মূল ৭টির প্রতি ছত্রের নিচে উর্দু তরজমা দেওয়া ছিল। অনেক দিন পরে আমারই কারণে নজরুল ইসলামের এই গ্রন্থখানা, আরো কিছু পুস্তক, কিছু চিঠিপত্র, অনেক দিনের পুরানো কবিতার খাতা, বিছানা, কিট-ব্যাগ, সুটকেস এবং ‘ব্যথার দান' পুস্তকের উৎসর্গে বর্ণিত মাথার কাঁটা সোয়া যায়।' (পৃ. ৪৯, ‘কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা' তৃ মুদ্রণ ১৯৬৯)। মুজফফর আহমদ বর্ণিত এই হাফিজের দিওয়ান বইটির বড়ো সংস্করণের বইটি থেকেই নজরুল তর্জমা করতে শুরু করেন। ‘মোসলেম ভারত' পত্রিকায়। ১৯২০ সালে। অন্যান্য পত্রিকাতেও আরো লেখা প্রকাশিত হয়। কী আছে হাফিজের দিওয়ান বইটিতে?- পার্বতীচরণ ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, ‘হাফিজের দিওয়ান ৫০০ গজল, তিনটি সুদীর্ঘ নীতিকবিতা, বহু রুবাই এবং কিছু মসনবীর ও কসীদার সমষ্টি। একমাত্র পুত্রের অকালমৃত্যুতে তার একটি মরসিয়াও আছে।' (পৃ. ২২০, পারস্য সাহিত্য পরিক্রমা, ১৯৮৪)। ১২০ এ প্রকাশিত নজরুল ইসলামের হাফিজ সংক্রান্ত রচনাও বিচিত্র : ১ আশায়। ‘প্রবাসী', পৌষ ১৩২৬। ২ প্রিয়ার দেওয়া শরাব। বঙ্গীয় মুসলমান-সাহিত্য প্রতীক : বৈশাখ ১৩২৭। ৩ বোধন। ‘মোসলেম ভারত' জ্যৈষ্ঠ ১৩২৭। ৪ বাদল রাতের সরাব। ‘মোসলেম ভারত', আষাঢ় ১৩২৭। ৫ সালেক (গল্প) ‘বকুল', আষাঢ় ১৩২৭। ৬ হাওয়ার দূতী। ‘উপাসনা' শ্রাবণ ১৩২৭। ৭ দিওয়ান-ই-হাফিজ (১-২)। ‘মোসলেম ভারত', অগ্রহায়ণ ১৩২৭। ৮ দিওয়ান-ই-হাফিজ (৩-৪)। ‘মোসলেম ভারত' পৌষ ১৩২৭। ৯ দিওয়ান-ই-হাফিজ (৫-৬)। ‘মোসলেম ভারত' মাঘ ১৩২৭। নজরুল ইসলাম হাফিজের দিওয়ানের বেশ কিছু তরজমা করেছিলেন। এরকম ৮টি তরজমা কবির সর্বশেষ কবিতাগ্রন্থ ‘নির্ঝর' (১৩৪৫) এ স্থান পায়। ‘প্রবর্তক' পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ ১৩৩০ সংখ্যায় আমি আর একটি দিওয়ানের অনুবাদ আবিষ্কার করেছি। (নৌজোয়ানীর জৌলুসে ঢের)। ঠিক কটি হাফিজের গজল অনুবাদ করেছিলেন নজরুল? অন্ততপক্ষে ১৩টি গজল যে অনুবাদ করেছিলেন তার সাক্ষ্য দেবে ‘প্রবর্তক' পত্রিকার আষাঢ় ১৩৩৩ প্রায় ‘দিওয়ান-ই-হাফিজ' শিরোনামে যে অনুবাদ ছাপা হয়েছিল (জাগো মাঝি হামদরদী')।, সেখানে লেখা ছিল গজল ১৩১। আমরা এখন পর্যন্ত দিওয়ানের ৯টি অনুবাদ পাচ্ছি। তাহলে কি অন্তত পক্ষে ৪টি দিওয়ান-ই-হাফিজ অনুবাদ করেছিলেন কবি? আপাততপ্রাপ্ত দিওয়ানগুলি এখানে প্রকাশের ক্রম অনুসারে চিহ্নিত হলো: ১ হ্যাঁ, ত্রয় সাকি, শরাব ভর লাহা। ‘মোসলেম ভারত', অগ্রহায়ণ ১৩২৭। ২ হে মোর সুন্দর। ঐ, অগ্রহায়ণ ১৩২৭। ৩ হতে হতে মোর। ঐ, পৌষ ১৩২৭। ৪ মোর পত্রের মদ্যরোশনায়ে। ঐ, পৌষ ১৩২। ৫ কোথায় সুবোধ-সংযমী। ঐ, মাঘ ১৩২৭। ৬ যদিই কান্ত সিরাজ সজনী। ঐ, মাঘ ১৩২৭। ৭ বুক-ব্যথানো বেণুর বেদন। বঙ্গীয় মুসলমান-সাহিত্য পত্রিকা, বৈশাখ ১৩৩০। ৮. নৌজোয়ানীর জৌলুসে ফের। প্রবর্তক' জ্যৈষ্ঠ ১৩৩০। ৯ জাগো সাকি হামদরদী। ‘প্রবর্তক', আষাঢ় ১৩৩৩। ধারাবাহিক প্রকাশক্রমের কথা বলা হলো, কিন্তু এই প্রকাশক্রমও হয়তো অল্প কেননা ‘নৌজোয়ানীর জৌলুসে ফের' পত্রিকাটি প্রবর্তকে প্রকাশিত হয় ‘সোনার বাংলা' থেকে উদ্ধৃত হিসেবে। ‘সোনার বাংলা' পত্রিকা আমরা দেখিনি, সুতরাং ওই পত্রিকায় ওই লেখা কবে প্রকাশিত হয়েছে বলা যাচ্ছে না। নজরুল-এর দিওয়ান-ই-হাফিজ সংক্রান্ত নতুন-প্রাপ্ত তথ্যগুলি এই ১. আগে আমাদের জানা ছিল না, ‘জাগো সাকি হামদরদী' প্রবর্তক পত্রিকায় বেরিয়েছিল; ২. যদিই কান্ড সিরাজ সজনী' কবিতায় ‘কুঞ্জিকা' মোসলেম ভারত' পত্রিকা থেকে ‘নির্ঝর' গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়নি- বাদ গিয়েছিলো ৩. নৌজোয়ানীর জৌলুসে ফের' কবিতাটিই অজ্ঞাত ছিল নতুন আবিষ্কৃত হলো। এই অনুবাদগুচ্ছের বৈশিষ্ট্য এগুলির শব্দ ব্যবহার এবং ছন্দ ও অন্তমিলের প্রয়োগ। বাংলার সঙ্গে এখানে নজরুল অবলীলায় মিশিয়েছেন আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দ। ছন্দে আমরা লক্ষ্য করি নানা বৈচিত্র : ১ ও ২ সংখ্যক গজল ৭ মাত্রায় মাত্রাবৃত্তে, ৩ সংখ্যক গজল ৬+৫+৬+৫ মাত্রাবৃত্তে, ৪-সংখ্যক গজল ২+৬+৬+৮ মাত্রাবৃত্তে এবং ৫, ৭, ৮ ও ৯ সংখ্যক গজল স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত। ১, ২, ৩, ৪, ৫ ও ৬ সংখ্যক গজল অসাধারণ যৌগিক অন্তমিলে সম্পন্ন। এই গজলগুচ্ছ শব্দ ছন্দ মধ্যমিল-অন্তমিলের কুশলতায় অসাধারণ। এগুলোকে মনে হয় পূর্ণসৃষ্টি। সব মিলিয়ে আমাদের মনে হয়েছে, হয়তো নজরুল ‘দিওয়ান-ই-হাফিজ' নামে কোনো বই এর পরিকল্পনা করেছিলেন। মুজফফর আহমদ বইটি হারিয়ে ফেলায় তা কি পরিত্যক্ত হয়েছিল? কিন্তু কলকাতায় ‘দিওয়ান-ই-হাফিজ'এর কোনো মূল সংস্করণ সংগ্রহ করা অসাধ্য ছিল না। নজরুল অন্যভাবে পরিব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন- হয়তো সেজন্যেও কাজ অসম্পূর্ণ থাকে। তবে, নজরুল-অনূদিত হাফিজের অন্তত আরো ৪টি গজল পাওয়া যেতেও পারে কোনো সময়। দীওয়ান-ই-হাফিজ নজরুল ইসলাম নৌ-জোয়ানীর জৌলুসে ফের গুলজার আজ গোলেস্তান, ফুল-কিশোরীর খোশ-খবরী গায় বুলবুল খোশ এলহান। যৌবনাতুর ফুলকুঁড়ি বাস যাচ্ছ মলয় ঘোড়সওয়ার, সরো, গোলাব, যুঁই, বেলীদের কইবে কি মোর নমস্কার? চাঁদ চেহেরায় ম্লান করো না কস্তুরী-কেশ-ধূপছায়ায়, চুনোট চুলের খুনসুটি তোর করবে এবার খুন আমায়। মদপায়ীদের নিত্য যারা বদনামী গায়, হচ্ছে ভয়- এই খারাবীর খেয়াল-সুখই ঈমান তাদের করবে ক্ষয়। খোদার প্রিয়ের হও প্রিয়তম- আছেন বুঝি ‘নোহের' নায় সিন্ধুকে যে বিন্দু ভাবে তুফান যাহার হুকুম চায়। শনির সরাই দুনিয়াখানায় পাতিসনে হাত, পালিয়ে আয়, অতিথি এলেই কঞ্জুসা এই কাফের করে কতল তায় মদ-পূজারী বাচ্চা পুঁড়ি পুতুল যদি হয় আমার নয়ন-পাতায় করবো ঝাড়ু সরাবখানার দোরেব তায়। ‘সোহহম সত্য' ‘জগৎ মিথ্যা' গন্ডুষে যদি নাও শুষেও দেহ-দেউলের কণা-রহস্য বুঝাতে নারবে বন্ধু কেউ। আখেরে যাহার সম্বল ভাই দু'মুঠো মাটির নিঁদ-মহল, বল সে বেকুবে, গগনচুম্বী সাত-মহলাতে তার কি ফল? হে মোর বন্দী কিনানের চাঁদ। মেঘের আজ তর দন্ডাধীন, কারাবাসে এবে বিদায় বলিয়া হও এসে যথা তখতনশীন। জানিনে লো তোর এলো কুন্তলে কি খেয়াল খেলে এলোমেলো, আ মলো! শ্যামল কস্তুরী-কেশ দিনে কতবার আলগে লো। মুক্তি মুলুক, সবুরীর কোঠা এমন অজেয় উচ্চশির জিনিবে তা বলে নাই হেন শত বাদশার তরবারির। মদ পি হাফিজ, মস্তানী চালা, বাস্ নেচে গেয়ে কাটুক কাল! অন্যের মতো করো না কোরানে ফেরেববাজির ফন্দী-জাল! নৌ-জোয়ানী=নবযৌবন। গোলেস্তান-মালঞ্চ। খোশ-খবরী=শুভসংবাদ। খোশ-এলহান= সুধা কণ্ঠ। বাগ=বাগিচা। সরো=পারস্যদের এক সুন্দর সরল তরুর নাম। প্রিয়ার ক্ষীণ, সরল, দীর্ঘতরুর সঙ্গে এর তুলনা দেন পারস্য কবিকুল। নোহ-হজরত নূহ এক বড় পয়গম্বর ছিলেন। এর প্রার্থনায় খোদার অভিশাপ তুফান রূপে এসে সমস্ত পাপাক্রান্ত পৃথিবী সয়লাব করে দেয়। কেবল ইনি এবং এঁর ধার্মিক পুণ্যাত্মা শিষ্যেরা এক জাহাজে চড়ে ঐ প্রলয় তুফান থেকে বেঁচেছিলেন। বাইবেলে, কোরানে এর বিবরণ আছে। কঞ্জুশ-কৃপণ। কতল=হত্যা। কাফের=এর মানে কবিতাতে প্রায় অধিকাংশ স্থলেই নিষ্ঠুর, অত্যাচারী। কিনানের চাঁদ=হযরত য়ূসোফ (বাইবেলের জোসেফ)। ইনি আগে বন্দী, পরে মিশরের অধীশ্বর হন। কোরানে বাইবেলে এর অপূর্ব কাহিনী বিবৃত আছে। তখতনশীন=সিংহাসনে আসীন। সবুরী=সহ্যগুণ ধৈর্য।
 

Chapters