অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় (৬ নভেম্বর ১৯৩০ (২২শে কার্তিক ১৩৩৭ বঙ্গাব্দ) - ১৯ জানুয়ারি ২০১৯) ছিলেন এক প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি লেখক।
জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৬ই নভেম্বর (২২শে কার্তিক ১৩৩৭ বঙ্গাব্দ) বৃটিশ ভারতের অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা জেলার আড়াই হাজার থানার রাইনাদি গ্রামে। (কিন্তু সার্টিফিকেট অনুসারে জন্ম তারিখ - ১লা মার্চ ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ। এটি সঠিক ছিল না। তার সাক্ষাৎকার দ্রষ্টব্য) তার পিতা অভিমন্যু বন্দ্যোপাধ্যায় মুড়াগাছা জমিদারের অধীনে কাজ করতেন। মাতার নাম লাবণ্যপ্রভা দেবী।  তার শৈশব কৈশোর কেটেছে গ্রামের বাড়িতে যৌথ পরিবারে। স্কুলের পড়াশোনা সোনারগাঁও এর পানাম স্কুলে। কিন্তু দেশভাগের পর ছিন্নমূল হয়ে তারা চলে আসেন ভারতে। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের বানজেটিয়া গ্রামে গড়ে ওঠা মণীন্দ্র কলোনিতে পিতার বাড়িতে কিছুকাল থিতু হয়ে থাকেন। এখান থেকেই প্রবেশিকা পরীক্ষা দেন। তারপর যাযাবরের ন্যায় কেটেছে তার যৌবন। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অধীনস্থ কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বি.কম.পাশ করেন ও পরে বি.টি. পাশ করেন। বি.টি.পড়ার সময়ই আলাপ হয় সহপাঠী 'মমতা'র সাথে। পরে তাকে বিবাহ করেন।
 
কর্মজীবন
এরপর কাজের সন্ধানে বেড়িয়ে পড়লেন। কখনো নাবিকরূপে সারা পৃথিবী পর্যটন, আবার কখনো বা ট্রাক-ক্লিনারের কাজ লেগে পড়া। পরে এক প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। অল্প কিছু দিন মুর্শিদাবাদ জেলার চৌরীগাছা স্টেশন নিকটস্থ সাটুই সিনিয়ার বেসিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন তিনি। তিন-চার বৎসর সাটুইয়ে থাকার পর ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি পাকাপাকি ভাবে চলে আসেন কলকাতায়। কখনো হলেন কারখানার ম্যানেজার, কখনো বা প্রকাশনা সংস্থার উপদেষ্টা। পরে অমিতাভ চৌধুরীর আহ্বানে যোগ দেন কলকাতার 'যুগান্তর' পত্রিকায় সাংবাদিকতার কাজে এবং সেখান থেকেই কর্মে অবসর নেন।
 
সাহিত্যকর্ম
বিভিন্ন পেশার মধ্যে থেকেও লেখালেখি করে গেছেন তিনি। তবে কলেজে পড়ার সময় থেকেই তার সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ জন্মে যায়। আর পেশার তাগিদে ঘুরে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন তাই স্থান পেয়েছে তার সাহিত্যকর্মে। তার প্রথম গল্প ওয়েলসের বন্দর শহর নিয়ে লেখা 'কার্ডিফের রাজপথ' প্রকাশিত হয় বহরমপুরের "অবসর" পত্রিকায়। তার এর পরের গল্প ছিল 'বাদশা মিঞা'। বহরমপুরের কলেজের বন্ধুদের আগ্রহে'উল্টোরথ'পত্রিকায় উপন্যাস প্রতিযোগিতায় জাহাজের জীবন নিয়ে প্রথম উপন্যাস "সমুদ্র মানুষ" লিখেই ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে 'মানিক-স্মৃতি পুরস্কার' লাভ করেন তিনি। এরপর তিনি তার অর্থসঙ্কট মেটাতে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে লিখে গেছেন বহু উপন্যাস। ছোট-কিশোর ও বড়দের সবার জন্যই তিনি লিখেছেন। তবে তার সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাসটি হল 'নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে'। এটি মূলতঃ চারটি সিরিজে বিন্যস্ত। প্রথম পর্ব 'নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে',দ্বিতীয় পর্ব 'মানুষের ঘরবাড়ি',তৃতীয় পর্ব 'অলৌকিক জলযান' এবং চতুর্থ পর্ব হল 'ঈশ্বরের বাগান'। দেশভাগের যন্ত্রণা নিয়ে লেখা এই উপন্যাসে ছিন্নমূল মানুষের জীবন,তাদের সংগ্রামী বিষয় এবং পটভূমিসহ জীবনের রোমাঞ্চকর অভিযানের লৌকিক অলৌকিক উপলব্ধি সুন্দরভাবে পরিস্ফুট হয়েছে। তার এই রচনা কেবল বাংলা সাহিত্যকে নয়,ভারতীয় সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। ভারতের ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট-এর উদ্যোগে ক্লাসিক পর্যায়ে বারোটি মূল ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলমে গ্রাম বাংলার জীবনও অনেক বেশি করে ধরা দিয়েছে। তাই তার মধ্যে অনেকে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরাধিকার খুঁজে পান।
পুরস্কার তালিকা
> মানিক স্মৃতি পুরস্কার - ১৯৫৮ সালে 'সমুদ্র মানুষ' এর জন্য।
> বিভূতিভূষণ স্মৃতি পুরস্কার - ১৯৯১ সালে।
> ভুয়ালকা পুরস্কার - ১৯৯৩ সালে পঞ্চযোগিনী এর জন্য।
> বঙ্কিম পুরস্কার - ১৯৯৮ সালে দুই ভারতবর্ষ এর জন্য।
> মতিলাল পুরস্কার
> তারাশঙ্কর স্মৃতি পুরস্কার
> নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ও সুধা পুরস্কার - কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
> সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার - ২০০১ সালে পঞ্চাশটি গল্প-এর জন্য
> শরৎ পুরস্কার- ২০০৫ সালে
> সুরমা চৌধুরী আন্তর্জাতিক স্মৃতি পুরস্কার (আই.আই.পি.এম প্রবর্তিত) - ২০০৮ সালে
সাম্মানিক মূল্য দশ লক্ষ টাকা 'নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে'-র জন্য
 
জীবনাবসান
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় দীর্ঘ দিন বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ই জানুয়ারি শুক্রবার বাথরুমে পড়ে যাওয়ার কারণে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়। কলকাতার পোর্ট ট্রাস্টের সেন্টিনারি হাসপাতালে ভর্তি হন। কিন্তু পরদিন শনিবার ১৯ শে জানুয়ারি বিকাল ৩টা ৪০ মিনিটে ৮৫ বৎসর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তথ্যসূত্র
১.  "অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার : আমার গোটা জীবনটাই তো ভুলে ভরা"। বণিক বার্তা। Archived from the original on ১৪ এপ্রিল ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ১৬ এপ্রিল ২০২০।
২.  "Atin Bandyopadhyay, 1934"। LOC। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জুলাই ২০১২।
৩.  "চলে গেলেন সাহিত্যিক অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়"। mzamin.com। সংগ্রহের তারিখ ১৬ এপ্রিল ২০২০।