৩য় উপাখ্যান || বত্রিশ সিংহাসন || ভারতীয় লোককাহিনী

পরদিন রাজা আবার যখন সিংহাসনে ওঠার জন্য তৃতীয় পুতুলের মাথায় পা দিলেন, তখন সেই পুতুল বললো, মহারাজ, আমার নাম সুপ্রভা, আপনি কি রাজা বিক্রমাদিত্যের মত আপনপর ভেদ ত্যাগ করেছেন? করে থাকলে এই সিংহাসনে বসুন।

ভোজরাজ বললেন, সেই রাজার আপনপর ভেদের কথা বল ।

পুতুল বললো, একদিন বিক্রমাদিত্য চিন্তা করলেন, এই সংসার অসার, কবে কার কি ঘটে তার ঠিক নেই। সুতরাং যদি উপার্জিত অর্থ দান বা ভোগ না করা যায় তাহলে সেই উপার্জন বিফল। অতএব সৎপাত্রে দানই একমাত্র উপায় । শাস্ত্রে আছে— অর্থ হয় ভোগ করতে হয়, নয় দান করতে হয়, আর কোনটাই না করলে বিনাশ হয়। জলাশয়ে যে জল সঞ্চিত থাকে তা পরকে দান করার জন্য, তেমনি উপার্জিত অর্থও দানের জন্য ।

এই ভেবে রাজা বিক্রমাদিত্য সর্বস্ব-দক্ষিণ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করার জন্য প্রস্তুত হলেন। শিল্পীরা সুন্দর মন্দির তৈরি করল, যজ্ঞের সব রকম সামগ্ৰী প্রস্তুত করা হল। দেবতা, মুনি, যক্ষ ইত্যাদি সকলে নিমন্তিত হলেন।

সমুদ্রকে নিমন্ত্রণের জন্য এক ব্ৰাহ্মণ গেলেন সাগরতীরে । সেই ব্রাহ্মণ সমুদ্রতীরে গিয়ে ষোড়শ উপাচারে সমুদ্রের পূজো করে বললেন, হে সমুদ্র, বিক্রমাদিত্যর হয়ে আমি তোমাকে নিমন্ত্রণ করতে এসেছি। এই বলে সাগরে পুত্রপঞ্জলি দিয়ে কিছুক্ষণ সেখানে বসে রইলেন। কিন্তু কেউ কোন উত্তর দিল না !

অবশেষে হতাশ হয়ে ব্রাহ্মণ যখন ফেরার জন্য সবে উঠে দাঁড়িয়েছেন, অমনি সমুদ্র এক সাধুর বেশে তাঁর সামনে এসে বললেন, বিক্রমাদিত্য আমাকে আমন্ত্রণ করার জন্য তোমাকে পাঠিয়েছেন। এতে আমি সম্মানিত হলাম। দূরে থাকলে বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায় এবং কাছে থাকলে বন্ধুত্ব আবার হয়, এ ভুল। বন্ধু দূরে থাকলেও তার প্রতি ভালবাসা কম হয় না। এখানে আমার কতকগুলি কাজের জন্য যেতে পারছি না আমি, এই যজ্ঞে ব্যয়ের জন্য বিক্রমাদিত্যকে চারটি রত্ন দিলাম। প্রথমটির সাহায্যে ধনরত্ন পাওয়া যায়, দ্বিতীয়টির সাহায্যে খাদ্যদ্রব্য পাওয়া যায়, তৃতীয়টির সাহায্যে ঘোড়া ও সৈন্য পাওয়া যায় আর চতুর্থটির সাহায্যে অলঙ্কার পাওয়া যায়।.

তারপর ব্রাহ্মণ সেই চারটি রত্ন নিয়ে উজ্জয়িনীতে ফিরে এলেন। তখন যজ্ঞ শেষ হয়ে গেছে। বিক্রমাদিত্য তাঁর সব ধনৰত্ন দান করে দিয়েছেন। কিছুই বাকী নেই। কিন্তু ব্ৰাহ্মণকে কী দেবেন? তখন তিনি ব্রাহ্মণকে বললেন, এই চারটির মধ্যে তোমার যেটা পছন্দ, সেটা নাও ।

ব্ৰাহ্মণ বললেন, আমি বাড়ি গিয়ে একবার সবাইকে জিজ্ঞাসা করে আসি ।

রাজা বললেন, তবে তাই কর।

ব্রাহ্মণ তখন বাড়ি গিয়ে সব কথা বললেন। শুনে তাঁর ছেলে বললেন, যে রত্নের সাহায্যে সৈন্য পাওয়া যায় সেটাই নিন। কারণ তাহলে সুখে রাজত্ব করা যাবে।

তাঁর স্ত্রী বললেন, যে রত্নের সাহায্যে খাদ্য পাওয়া যায় সেটাই নাও। কারণ খাবারের জন্যই সবাই বেঁচে আছে।

পুত্রবধু বললেন, যে রত্বের সাহায্যে অলঙ্কার পাওয়া যায় সেটাই নিন। কারণ অলঙ্কারের সাহায্যে দেবতাদেরও প্রীতি লাভ করা যায়।

ব্রাহ্মণ নিজে বললেন, যে রক্তের সাহায্যে ধন পাওয়া যায়, সেটাই নেওয়া উচিৎ। কারণ ধন দিয়ে সব হয় ।

ব্রাহ্মণ তখন রাজার কাছে এসে চারজনের মতের কথা বললেন। রাজা তখন তাঁকে চারটি রত্নই দান করলেন ।

পুতুল গল্প শেষ করে ভোজরাজকে বললো, মহারাজ, আপনি যদি এমন দাতা হন তাহলে এই সিংহাসনে বসুন।

ভোজরাজ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন।

Chapters